Hot Posts

6/recent/ticker-posts

বিক্রম ভিলা রহস্য পর্ব (২)

 


তন্ময়দের বাড়িটি দুই তলা। বাড়িটি বেশ পুরোনো এবং বন্ড। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার ঠাকুরদার বাবা বিক্রম চ্যাটার্জী এই বাডিটি বানিয়েছিলেন। তার নামেই বাড়িটির নাম 'বিক্রম ভিলা'। বাভিটির সামনে অনেকটা জায়গা। দুই দিকে ফুলের গাছ। মাঝখান দিয়ে ঢালাই করা পথ। বাড়ির পেছন দিকেও অনেক জায়গা রয়েছে। সেখানে প্রচুর গাছ-গাছালি, পুকুর আছে। বাড়ির পূর্ব দিকে কিছুটা দূরে একটা মন্দির আছে। তন্মযদের প্রচুর জায়গা জমি, কাঠের আড়ত ও নানা রকমের বাবসা রয়েছে। তারা পূর্ব পুরুষ ধরে বড়লোক। তাদের যৌথ পরিবার। তার বাবা সুরেনবাবুরা দুই ভাই এক বোন। সুরেনবাবুর দিদি লতা বড়। পাশের গ্রামে ভাব স্বশুরবাড়ি। সুরেনবাবু মেজো আর ছোট ভাই ভুবনবাবুর এক ছেলে এক মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়নি। তন্ময় তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।


তন্ময় আর স্নিগ্ধা ঢালাই করা পথ পেরিয়ে সিঁড়ির উপর এসে দাঁড়াল। স্নিগ্ধা মাথায় চাদর টেনে ঘোমটা দিল। পরিবারের লোকেরা তাদের দেখে কী প্রতিক্রিয়া দেবে, সেই ভেবে তন্ময়ের বুক দুরুদুরু করছে। স্নিগ্ধার মনেও ভয় আর উত্তেজনার মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে।


তন্ময় নরম গলায় ডাকল, মা-।


কিন্তু কোনো সাড়া পেল না।


এবার সে একটু জোরে ডাকল, কনিকা-।


কাকার মেয়ে কনিকা হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। বয়স উনিশ, দেখাত মিষ্টি। তার হাতে একটা বরণডালা। ডালার ভেতরে ছোট একটি প্রদীপ নিবু নিবু করে জ্বলছে।


কনিকা বলল, মা, জেঠিমা, এসো তোমরা।


তন্ময় তাকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিস তোরা?


কনিকা হেসে বলল, বারে, তুমি বড়বৌদিকে নিয়ে এসেছো। আমরা কি তাকে বরণ করব না?


তন্ময় অবাক হয়ে বলল, তোরা কী করে জানলি আমি স্নিগ্ধাকে নিয়ে এসেছি?


-গাড়ি আসল। তুমি বড়বৌদিকে নিয়ে নামলে। রতনদার সাথে কথা বলছিলে, সব আমি দেখেছি।


রকি ছুটে এল। রকি হল এদের বাড়ির পোষ্য। ল্যাব্রাডর কুকুর।


রকি তন্ময়ের গা বেয়ে উঠছে আর ঘেউ ঘেউ করছে। তন্ময় তাকে আদর করছে। রকির গা প্রচন্ড ঠান্ডা।


তন্ময় কনিকাকে বলল, রকিকে জামা পরা। শীতে ওর গা ঠান্ডা হয়ে গেছে। এবার সে লক্ষা করল কনিকার চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। তাকে কেমন

একটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।


তন্ময় বলল, ভাল আছিস বোন?


কনিকা তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, বড়বৌদি, সামনে এস।


স্নিগ্ধা তন্ময়ের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। সে সামনে এসে দাঁড়াল।


তন্ময়ের মা আর কাকিমা সামনে এল। প্রদীপের অল্প আলোয় তাদের আবছা দেখা যাচ্ছে।


তন্ময় তাদের দেখে কী বলবে বুঝতে পারছেনা। সে স্নিগ্ধাকে বলল, এই হল আমার মা আর কাকিমা।


স্নিগ্ধা তাদের নিচু হয়ে প্রনাম করতে গেলে তারা দুজনেই পেছন দিকে সরে গিয়ে বলল, বেঁচে থাকো।


স্নিগ্ধা আর তন্ময় লক্ষ্য করল তারা হাসছে ঠিকই কিন্তু সে হাসিতে কোনো প্রাণ নেই।


স্নিগ্ধা ভাবল, সব আমার জন্য। তন্ময় তাদের বড় ছেলে। তাদের কত আশা ছিল ধুমধাম করে আড়ম্বডের সাথে নিজেদের পছন্দের মেয়ে পল্লবীর সঙ্গে তারা তাদের ছেলের বিয়ে দেবেন। তাদের সব আশা আমার জন্য ভেঙে গেছে। সেজন্য তাদের মনে কষ্ট আছে। আমি আমার বাবহার আর কর্মের দ্বারা এদের এই প্রাণহীন হাসিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটাব।


কনিকা তার মা, জেঠিমার দিকে তাকিয়ে বলল, বড়দা-বড়বৌদি আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? তাড়াতাড়ি বরণ করো।


কনিকার মা, জেঠিমা তাদের বরণ করলেন।


তন্ময়ের মা অরুণাদেবী কনিকাকে বললেন, ওদের ঘরে নিয়ে যা। তন্ময় কলিকাকে বলল, আলো জ্বালাসনি কেন?


কনিকা ক্ষীণ স্বরে বলল, মনে নেই রে দাদা। জ্বালাচ্ছি।


কথাটা শুনে তন্ময় বিস্ময়ের সাথে বলল, কী বলিস? রাত হয়েছে অথচ আলো জ্বালাতে মনে নেই।


কনিকা কিছু না বাল কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালাল।


তন্ময় মায়ের দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বলল, আমার উপর এখনো রেগে আছো মা?


অরুণাদেবী মুখে হালকা হাসি এনে বললেন, মা কখনো ছেলের উপর বাগ করে থাকতে পারে? তাছাড়া বৌমা আমার ঠিক দুর্গার মত। তোরা ভেতরে যা। অনেকটা পথ এলি। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হ। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি। আয় ছোট বউ।


বলে তিনি তন্ময়ের কাকিমা তন্দ্রাদেবীর হাত ধরে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।

তন্ময়ের মনটা একটু হালকা হলেও সে ভাবতে লাগল তার বাবার কথা। তিনি এসে কী বলবেন কে জানে।


তন্ময়ের বাবা রাশভারী মানুষ। তিনি মেপে কথা বলেন।


কনিকা স্নিগ্ধা আর তন্ময়কে বলল, এস তোমরা।


বারান্দা পেরিয়ে তারা হলঘরে ঢুকল। কনিকা এবারও একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালাল। সব কিছু হালকা দেখা যাচ্ছে। বিরাট হলঘর। দামি দামি ফার্নিচার রাখা আছে। স্নিগ্ধা দেখে অবাক হল। কারো বাড়িতে এত বড় হলঘর সে আগে দেখেনি। দেখবেই বা কী করে? শহরে এত জায়গা কয়জনের আছে। তাছাড়া তার বন্ধু-বান্ধবেরাও তাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাদের বাড়ি বা ফ্লাটও ছোট ছোট।


হলঘরের এক পাশ দিয়ে সিডি। কনিকা অন্ধকারে গড়গড় করে সিডি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।


--অন্ধকারে যাসনা। পড়ে যাবি।


বলে তন্ময় সিডির লাইটটার সুইচে চাপল। কিন্তু আলো জ্বললনা।


কনিকা হেসে বলল, জ্বলবেনা বড়দা। বাল্বটা কেটে গেছে।


-31


কনিকা নেমে এসে স্নিগ্ধার হাতে একটি টর্চ দিয়ে বলল, এটি জ্বালিয়ে উঠে এস।


তারা উপরে উঠল।


তন্ময় কনিকাকে বলল, বাবা আমার উপরে খুব রেগে আছে তাইনা?


--না বড়দা। কথাটা বলে কনিকা দরজার দিকে তাকাল। কেমন একটা


ভয়ের ছাপ তার চোখে মুখে ফুটে উঠল। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, তোমরা ঘরে গিয়ে আলো জ্বেলে ফ্রেশ হয়ে খেতে এস।


কনিকা আর দেরি না করে তৎক্ষণাৎ নিচে নেমে এল।


ব্যাপারটা স্নিগ্ধার কেমন অদ্ভুত লাগলেও সে কিছু বললনা।


ঘরে ঢুকে তন্ময় লাইট জ্বালাল। ঘরটিতে ধুলো, ঝুল জমে আছে।


তন্ময় খাটের উপর বসে হেসে বলল, এই হল এই অধমের ঘর। পছন্দ হয়েছে তো?


স্নিগ্ধা ঘরটির চারিদিকে তাকিয়ে বলল, চমৎকার ঘরটি।


তন্ময় শুয়ে পড়ল।


- অ্যাই। ধূলোর উপর শুয়ে পড়লে? ওঠো।


জন্ময় বলল, না শ্রেয় আর পারছিনা। এখনইতো স্নান করব।

--এইটুকু জার্নিতেই কষ্ট হয়ে গেল?


--এইটুকু কোথায়? সারাদিনই তো--


স্নিগ্ধা ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতে করতে বলল, বেশ, এবার বলো ঝাড়ুটা কোথায় আছে?


--এতটা জার্নি করে এলে কাল পরিস্কার করো। এখন যে করে হোক রাতটা কাটিয়ে দিলেই হবে।


-চুপ কবো তো! এই ধুলোবালি আর ঝুলকালির মধ্যে থাকা যায় নাকি?


তন্ময় ঝাড়ু আনতে ঘর থেকে বেরোল।


স্নিগ্ধা দেখল। ফোনটা মিউট হয়ে রয়েছে। তার বাবা-মায়ের অনেকগুলো মিসড কল। সে কল করে বাবা-মাকে বলল, চিন্তা করোনা। সব ঠিক আছে। আজ খুব ক্লান্ত। পরে কথা বলব।


তন্ময় ঝাড়ু নিয়ে এল। স্নিগ্ধা ফোনটা রেখে ঘরটা ঝাড়তে লাগল। ঘরটির সাথে অ্যাটাস্ট বাথরুম। তন্ময় বাথরুমে ঢুকল।


কনিকা এসে দরজার পর্দার আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, তোমাদের খাবার তৈরি বড়বৌদি। তোমরা বলে কয়ে আসোনি তাই ঘরটা পরিষ্কার করা হয়নি। আমি ঘরটা ঝেড়ে দিচ্ছি। তোমরা ফ্রেশ হয়ে খেতে যাও।


স্নিগ্ধা তার দিকে মুখ ফেরাল। তাকে আবছা দেখা যাচ্ছে।


স্নিগ্ধা বলল, ভেতরে এস বোন।


তন্ময় স্নান সেরে বাথরুম থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরোল। সে স্নিগ্ধাকে বলল, পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি স্নান করে এস।


সে দরজার কাছে এসে কনিকাকে দেখে বলল, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছিস


কেন? ভেতবে আয়।


--না। তোমরা ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো।


--ঠিক আছে।


কনিকা নিচে গেল।


স্নিগ্ধা ভাবল তন্ময়ের পরিবার এমনিতে আমার উপর বেগে আছে। তার উপর খেতে যেতে দেরি করলে আরো রেগে যেতে পারে। খেয়ে এসে বিছানার চাদরটা পাল্টে শুয়ে পড়ব। সকালে উঠে ঘর পরিষ্কার করব।


স্নিগ্ধা বাথরুমে ঢুকল। বাথরুমটা অনেকদিন ব্যবহার হয়না বোঝা যাচ্ছে। বাথরুমটা খুব সুন্দর এবং বড়। কোলকাতায় তাদের বাথরুমের মত ছোট নয়। সেখানে হাত পা ছড়িয়ে ঠিক মত স্নান করা যায়না।

দেওয়ালের এক দিকে আয়না বসানো আছে। আয়নায় ধুলো পড়েছে। বাথরুমে গিজার আছে। তন্ময় গিজার চালিয়ে রেখেছে।


স্নিগ্ধা স্নান করে বাইরে বেরোল। সে একটা হলুদ রঙের সুতির শাড়ি পরল। এখানে বেশ ঠান্ডা। সে সোয়েটারের উপর চাদরটা জড়িয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে দিল।


তন্ময়ের বুকটা ঢিপঢিপ করছে। বাবা-কাকু এসে ওরা এসেছে শুনে সারা বাডি মাথায় না তোলে। হরিকাকারও দেখা নেই। কোথায় গেছে কে জানে। একমাত্র সে তাকে বোঝে। হামেশাই সে তার সাথ দিয়ে থাকে।


তন্ময় স্নিগ্ধাকে নিয়ে মনমরা হয়ে নিচের তলায় নামল।


(চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ